(শহীদ আজাদের মা)
আজ ৩১আগস্ট, শরতের এমন এক দিনেই ৩৩বছর আগে(১৯৮৫) সাফিয়া বেগম অর্থাৎ, শহীদ আজাদের মা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
পৃথিবীর অত্যন্ত দুঃখী একজন মানুষ ছিলেন সাফিয়া বেগম। খানিক সময়ের জন্য সুখ তার জীবনে ছিল, একটা ঝড় যেন সব ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিল। তাঁর জীবনে তিনি দুঃখী হলেও এই বিশ্ব তাঁকে চিরকাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন গর্বিত মা বলেই আখ্যায়িত করবে।
স্বামীর একটি ভুল তার জীবন তছনছ করে দিল, এক কাপড়ে বেড়িয়ে আসেন স্বামীর রাজপ্রাসাদ থেকে। যে মানুষটিকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন, তার দ্বারা বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়ার পর কোনদিনও স্বামীর মুখ দেখেন নি(১৯৬১ থেকে আমৃত্যু), নিজের মুখও দেখান নি। তাঁর নিয়তি তাঁকে চুরমার করার জন্য যতটা চেষ্টা করা যায় করেছিল। কিন্তু কোনদিনও অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াননি। কারণ একজন নারীর আত্মসম্মানে আঘাত আসলে সেই নারী পৃথিবীর সব প্রতিকূল পরিবেশকে কঠোর হস্তে দমন করার শক্তি অর্জন করে ফেলে।
আজাদই ছিল তাঁর বেচে থাকার একমাত্র কারণ। তাঁর শিক্ষায় গড়ে তোলা এই সন্তানই আজ আমাদের গর্বিত করে তোলে, আমাদের অহঙ্কারি করে তোলে বিশ্ব আসরে। আজাদ মারা যাওয়ার ১৪বছর পর্যন্ত তিনি আজাদের অপেক্ষায় ছিলেন, এই ১৪টিবছর তিনি ভাত খাননি কারণ তাঁর আদরের মানিক শেষ দেখায় তার কাছে ভাত খেতে চেয়েছিল, ১৪বছর মেঝেতে শুয়েছেন কারণ তাঁর ছেলে বন্দীদশায় কোন খাট পায়নি।
শহীদ আজাদের মা মারা যাওয়ার পর তাঁর বোনের ছেলেকে দিয়ে যাওয়া সিন্দুক থেকে ১০০ভরি গয়না পাওয়া যায়। এই গয়নাগুলো তিনি তার পুত্র বধুর জন্য রেখেছিলেন। এত কষ্ট করলেন কিন্তু ছেলের বউ এর ভাগের গয়নায় হাত দেননি কোনদিন। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মা যেন একেকজন দেবীরূপে পৃথিবীতে অবতরণ করেন।
ভাগ্যের নির্মম সত্যতা এই যে ইতিহাস তাঁর বেচে থাকার একমাত্র কারণকে তাঁর থেকে চিরতরে ছিনিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিয়ে গেল....
আজাদ করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাকে একটি চিঠিতে বলেছিল যে, সে যদি কখনো নামকরা হয়, বড় হয়, তাহলে সে সবাইকে জানাবে তার মায়ের কথা, রচনা করবে তার জীবনী। আজাদ আজ তার কল্পনার চেয়েও অনেক বড় হয়েছে। তার কীর্তি পৃথিবীতে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। আর তার মায়ের এই জীবনী, কোটি কোটি দুঃখী মানুষকে বেঁচে থাকার আলো দেখিয়েছে। এজন্য স্বনামধন্য লেখক আনিসুল হককে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। তাঁর একাগ্র প্রচেষ্টা এবং দৃঢ়তা "মা" উপন্যাসটিকে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রে পরিণত করেছে।
"মা" উপন্যাসটির একটা অনুচ্ছেদ না লিখলেই নয়....
"আজাদের মা কে দাফন করে এসে জাহানারা ইমাম কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসেন। কারণ তিনি মা। একটা লোক যখন মারা যায়,
ভাইয়ের কাছে সেটা চলে যাওয়া;
বোনের কাছে শূন্যতা;
বাবার কাছে তার নিজেরই ধারাবাহিতার ছেদ;
বন্ধুর কাছে সেটা অতীত ম্মৃতি আর বিস্মৃতির দোলাচল;
পড়শির কাছে তা দীর্ঘশ্বাস;
দেশের কাছে কালের কাছে হয়তো তা প্রিয়তম পাতার ঝড়ে যাওয়া;
কিন্তু মায়ের কাছে? মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যু হলো সমস্ত সত্তাটাই মৃতের দ্বারা দখল হয়ে যাওয়া, মায়ের স্মৃতি, মায়ের অস্তিত্ব, তাঁর নিদ্রা, তার জেগে থাকা, তাঁর স্বপ্ন, সবটা জুড়েই পুনর্বার জন্ম নিয়ে বিপুলভাবে বেড়ে উঠতে থাকে তাঁর গতায়ু সন্তানটি"
ভেবেছিলাম আরো কিছু লিখবো.... কিন্তু চোখের জল একাকার করে দিল।
কষ্টটা তখনই লাগে যখন দেখি আমাদের প্রজন্মের অনেকেই শহীদ আজাদকে চেনে না, জাহানারা ইমামকে চেনে না........
©All content on this blog is protected by copyright law. Unauthorized use, reproduction, or distribution of any articles without permission is strictly prohibited. Legal action may be taken against violators.
No comments:
Post a Comment